কার্তিকের কুয়াশা

 

অসমাপিকা

সজল শর্মা

পূর্ণিমা শেষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ নিজের অস্তিত্ব জানাতে মাঝরাতে আকাশে জ্বলে উঠেছে। নিস্তব্ধ রাত। ঝিঁঝিরাও বিরাম দিয়েছে। বাতাসও বিশ্রামে। শুধু পুষ্করিনির জল আপন স্বভাবে তেল ফুরানো বাতির মত নিভুনিভু চাঁদের আরেকটি ছবি নিজের বুকে এঁকে রেখেছে। জলচরদের নিশাচরি আলোড়নে সেই চাঁদ মাঝে মাঝে একের অধিক হচ্ছে। এক হচ্ছে। এমন অসুন্দর ভাগ্যপীড়িত রাতকে নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে তরুশেখর নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করল। জগতে তার মত অনেকেই আছে।

কেন যে মাঝে মাঝে জীবনের খাতা এমনভাবে খোলে যায় তার যথার্থ কারণ খুঁজে মেলে না। শুকিয়ে যাওয়া ঘা কেন হঠাত করে তীব্র যন্ত্রনায় তার গলিত ভাব নিয়ে ফিরে আসে। কেন সবকিছুর মাঝে বেঁচে থেকেও অনেক কিছুই অস্তিত্বহীন হয়ে থাকে। আবার কখনও এমন অস্তিত্ব নিয়ে জাগে যে মনে হয় বড় বৃথা এক বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে দিনরাতের পালা দেখে যাচ্ছে। সেইসব অতীত কবেই তো দূরাতীত হয়ে গেছে। শ্মশানে শায়িত লাশের মত পচে গিয়ে গলে গিয়ে কবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, যেখানে মাটি আর শুধুই মাটি। এই তো যে সকাল চলে গেল তখনও তা তার কোন অপূর্ণতা ছিল না। সন্ধায়ও ছিল না। কেন এই মাঝরাতের হিসেবে তার এত অপূর্ণতা, কেন এত শূন্যতা।

পুরনো দিনের কিছু বন্ধু এক হতেই শুরু হয়েছিল অতীতের গল্প। এমন নয় যে অতীতে শুধু সুখ ছিল, এমন নয় যে, অতীতে শুধু শান্তি ছিল, হাসি ছিল, আনন্দ ছিল। বর্তমানের স্বাভাবিক পরিক্রমার মত অতীত সময়েও ছিল হাসি-কান্না। তীব্র যন্ত্রনা, অথবা সুখের বিহবলতায় মরে যাবার মত। কিন্তু গল্পের ছলে যখন অতীত এসে মনের দুয়ারে দাঁড়াল, একে একে সব শুকানো ফুল যখন আবার কলি হয়ে উঠল, পাপড়ি মেলেতে লাগল; তরুশেখরের মনে হল অতীতের সবই সুখ ছিল। সবই আনন্দ ছিল। শান্তি ছিল। যদি তার বিপরীত কিছু থেকে থাকে তাহলে বিস্মৃত। সে জোর করেই সিদ্ধান্ত দিল, অতীতে বিপরীত কিছু ছিল না।

তার মনে পড়ল, তিতির সাথে নির্জন কক্ষে অভিমানভাঙ্গা এক সকাল। তিতির মান ভাঙ্গিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে আসা পরিচিত বড়দিদি যখন ‘তোমাদের কাজ তোমরা কর’ বলে দরজা ভেজিয়ে চলে গিয়েছিলেন, তাদের হাত হাতে মিলেছিল। তিতির মাথাটি আলগোছে তরুশেখরের কাঁধে পশিম আকাশে হেলান দেওয়া দ্বিতীয়ার চাঁদের মত হয়েছিল। সেই স্পর্শের শিহরণ, সেই মিলনের সুখ, এত বছর পরেও যেন সেই দিন নিয়ে মনের দোয়ারে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকল। চমকে গিয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে কোন হাত খুঁজে পেল না। তার কাঁধে নির্ভরতায় শায়িত কারও মাথা পেল না। অথচ বুকের মাঝে সবই আছে। সবই উতলে উতলে উঠছে।

পানিতে ছোড়া ঢিল যেমন জলকে নাড়িয়ে যায়। তেমনই স্মৃতির ভারে কাতর করে গেল এক স্মৃতি। সেই জল আলোড়নের মত আবার থেমে গেল। আবার কোন জলচরের পুচ্ছের আঘাতে জলের কম্পনের মত দোয়ারে এসে দাঁড়াল শিরি। শিরি হাতে ধরা ভাতের থালাটি তখনও বাষ্প চড়াচ্ছে। যেন এই মাত্র গরম ভাত তুলে এনেছে। এই মাত্র ইলিশ-ঝিঙের ঝোল তার পাতে ঢেলে দিয়েছে। তার হাতে পাতের ভাতটুকু শেষ করে আঁচলে হাত মুছল তরুশেখর। শিরির চোখে তখন তৃপ্তি। এমন তৃপ্তির ছবি নারী ছাড়া কারও চোখে আঁকা হয় না। নিবেদনে নারী ছাড়া কেউ আর এত তৃপ্ত হয় না। নারীই তো নিবেদন-দানের অন্নপূর্ণা। জগতের সকল নারীই এমন। তাদের চোখের ছবি এমন। স্নেহভরা কলমির ঝিলের মত। অভিধানের নিবেদন আর অর্ঘ শিরির প্রতিমূর্তি হয়ে দাঁড়ায়। রোদমাখা গ্রীষ্মের জ্বলন্ত পথে মেঘের ছায়া হয়ে দাঁড়ায়। নিস্তব্ধ বায়ুহীন রাতে হাসনাহেনার গন্ধভরা হাওয়ার ঝাপটা হয়ে দাঁড়ায়।

কী সুখ ছিল সেই চোখে ডুবে গিয়ে! কী শান্তি ছিল তার আঁচলের ঘ্রাণে। তার বিলিকাটা চুলে। তার কথায়। তার হাসিতে। সেই চোখের ভরাজল সকালের বিরহ দিনের কথা মনে হতেই চিনচিনে এক রক্তস্রোত বয়ে গেল।

তীব্র খরার শেষে বৃষ্টি দীর্ঘ বাদল নিয়ে নামে। তেমনই একের পর এক উত্তাল অতীত ভর করছে এসে। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তরুশেখর অজান্তেই রওয়ানা হয়েছিল। পেছনে বন্ধুদের আরেকটু বসে যাওয়ার আহবান তার কানে ঢুকেও ঢুকেনি। তার একটু নিরব সময় চাই। নিবিড় অন্ধকার চাই। একটু নেশা চাই। সমাধিগ্রস্থ কিছু ভাবনা চাই। অতঃপর পরিত্যক্ত পুষ্করিনি খদ্দের বিহিন নাগরীর মত তাকে পরম প্রেমে কাছে ডাকল। একে একে অতীতের অথই জলরাশি থেকে মাথা তুলল তিতি, শিরি, পৃথা, নিতা। তাদের সকল নাম একসাথে এসে জড় হয়। অথচ সময়ের লেখচিত্রে তাদের অবস্থান দ্রাঘিমা দ্রাঘিমা দূর ছিল। অস্তিত্ব ভিন্ন ছিল। যদিও উপসংহার ছিল তিথির অতিথির মত। রাতের শিউলির মত যে সকালে ঝরে যায়। উল্কার মত, যে দেখা দিয়ে নিভে যায়।

জলে যেমন অযুদ চাঁদের বিম্ব এক হয়ে যায়, তার হৃদয় তেমনি সবাইকে ধারণ করে আছে। তার মনে হল, সে সবাইকে ভালবাসে। যেটুকু ভালবাসা সে প্রথম প্রেমের তিতিকে ভালবেসেছিল। ততটুকুই ভালবেসেছিল নিতাকে। ততটুকু ভালবাসে শিরিকে, পৃথাকে। আজ যদি তরুশেখর তার হৃতপিণ্ড উইল করে দিয়ে যেত, তাহলে অলিন্দ-নিলয়ের সকল ভালবাসা সমান করে ভাগ করে দিতে ডাক্তারদের বোর্ড বসলেও সমাধান হত না। আদালতের বিচার অসমাপিকা হয়েই থাকত।

সেই কবেকার কার কার চোখে প্রেম বিরহের জল জাগিয়েছিল তরুশেখর, তার হিসেব শুরু করতেই নিজেই অপরাধীর কাঠগড়ায় স্বেচ্ছায় দাঁড়াল। এমন না যে, সব ভুল তার। তাকেই স্মৃতির সিন্দুকে জমানো অতীতের বন্দুক উঁচানো আস্ফালন মেনে নিতে হবে। তবুও সে মেনে নিল। মনের আদালতে তার মৃত্যুদণ্ড হলেও সে আপিল করত না, উকিল ধরে শুধু তার দোষ নয় অন্যের আছে প্রমান করতে চাইত না।

অন্ধকার বিছানায় ঢলে পড়ে যখন তরুশেখরের চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ছে, সেই জলের ভাগ কাকে দেব তা বিচার করতে পারলাম না। প্রশ্ন জাগল, কারে দান দিলি এই জল? বিছানার অনুভূতি থাকলে সে প্রতিবাদ করে তরুশেখরকে বিছানা ছেড়ে যেতে বলত। নির্ঘুম রাতের ছটফটানি ভুক্তভোগী ছাড়া কে বা বলতে পারে। তরুশেখরের অন্তর্যামী হলেও আমার কাছে তা অবোধ্য হয়ে রইল। অন্তর্যামী হলেই- সবকিছু জানতে নেই!